Published using Google Docs
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি - গোলাম মুরশিদ
Updated automatically every 5 minutes

মাসদুা ভাট্টি

হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি - গোলাম মুরশিদ

জাতি হিসেবে বাঙালির ইতিহাস কি সতি্যই হাজার বছরের? প্রশ্নটি বহুবার বহুমুখে উচ্চারিত। আমার মনে হয়, ইতিহাসের বয়স দিয়ে নয়, বরং তার প্রামাণ্যতা দিয়েই তার বিচার হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে বাঙালি জাতি-ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও প্রমাণযোগ্যতাই গবেষণাকাজের মূল্য নির্ধারণ করবে। স্বনামখ্যাত গবেষক, লেখক গোলাম মুরশিদের সর্বশেষ গবেষণাগ্রন্থ 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' তাই সাধারণ বাঙালি পাঠকের জন্য একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ বলে আমার মনে হয়েছে। শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, এই রচনাটি উল্লিখিত গ্রনে্থর কোনো সমালোচনা নয়। অর্থাৎ যে অর্থে আমরা পুস্তক সমালোচনা বলে থাকি, যার শেষে সাধারণত উল্লেখ থাকে, 'প্রচ্ছদ শোভন, তবে মূল্য একটু বেশি' জাতীয় বাক্য, সেই উদ্দেশ্যে নিবন্দটি লিখিত নয়। বরং বইটি পাঠের পর একজন সাধারণ পাঠকের মনে আসা প্রশ্ন এবং চিন্তা-ভাবনা নিবল্পেব্দর পাঠকের সঙ্গে বিনিময় করাই এর উদ্দেশ্য। সহজ-সরল ভাষায় গোলাম মুরশিদ আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছেন এমন এক অবস্থানে, যেখানে আমাদের জাতি-ইতিহাসের সূত্রপাত। আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শেকড়ের সঙ্গে, একটি মহীরুহের জন্মকাল সম্পর্কে আমাদের তিনি জানাতে চেয়েছেন। আমাদের জাতিগত বিভ্রান্তির এই কালে বইটি তাই বিশেষভাবে উল্লেখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ।

গোলাম মুরশিদ লিখেছেন 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' ইতিহাসের ধারাবাহিকতার কথা। তিনি প্রথমেই আমাদের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন সংস্কৃতি কী সে সম্পর্কে। বহু মনীষী, বহু প িত ব্যক্তি একে সংজ্ঞায়িত করলেও গোলাম মুরশিদ বেছে নিয়েছেন প িত এডওয়ার্ড টেইলরের সর্বজনগ্রাহ্য ধ্রুপদী সংজ্ঞাটি। অর্থাৎ 'মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ এবং জ্ঞানের একটি সমনি্বত প্যাটার্নকে বলা হয় সংস্কৃতি। ভাষা, সাহিত্য, ধারণা, ধর্ম ও বিশ্বাস; রীতিনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিয়মকানুন; উৎসব ও পার্বণ; শিল্পকর্ম এবং প্রতিদিনের কাজে লাগে এমন হাতিয়ার ইত্যাদি সবকিছু নিয়েই সংস্কৃতি। সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ যেসব শিক্ষা, সামর্থ্য এবং অভ্যাস আয়ত্ত করে_ তাও সংস্কৃতি।' অর্থাৎ গবেষক আমাদের তথা বাঙালির প্রতিদিনকার জীবনযাপনের যে ক্রমান্বয়িক পরির্বতনের ফলে আজকের আমরায় এসে দাঁড়িয়েছি তার ইতিহাস শোনাতে চেয়েছেন। এর মাঝে সুপ্ত থাকবে বাঙালিত্বের জন্ম, ভাষার জন্ম, জাত্যাভ্যাসের জন্ম ও বির্বতন এবং সেই সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক পরির্বতনও। যদিও লেখক আমাদের জানিয়ে দিতে ভোলেন না যে, তিনি রাজনৈতিক নয়, সংস্কৃতির ইতিহাস লিখছেন মাত্র। কিন্তু রাজনীতি কি সংস্কৃতির বাইরে? এরকম প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক, যদিও তার উত্তরও আমরা পেয়ে যাই, ধীরে ধীরে যখন আমরা প্রবেশ করি গ্রনে্থর ভেতরে।

মোট চৌদ্দটি অধ্যায়ে বইটি বিভক্ত। এর মধ্যে সূচনা অধ্যায়েই আমরা জেনে যাই বাঙালির জাতজন্মকথা। তারপরই গবেষক আমাদের ধীরে ধীরে আধুনিক বাঙালি হওয়ার কথা শোনান যথাক্রমে ক) ইন্দো-মুসলিম আমলে সংস্কৃতির রূপান্তর (দ্বিতীয় অধ্যায়); খ) বাংলার সমাজ ও ধর্ম (তৃতীয় অধ্যায়); গ) পশ্চিমের অভিঘাতে বাঙালি সংস্কৃতি (চতুর্থ অধ্যায়); ঘ) বিশ শতকের বাঙালি সংস্কৃতি (পঞ্চম অধ্যায়) শিরোনামে রচিত অধ্যায়সমূহে। এরপর ষষ্ঠ থেকে চতুর্দশ অধ্যায় পর্যন্ত গবেষক যথাক্রমে ক) প্রণয়, পরিণয়, পরিবার; খ) বাঙালি নারী ও বাঙালি সংস্কৃতি; গ) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য; ঘ) বাংলা গানের ইতিহাস; ঙ) নাটক ও সিনেমা; চ) স্থাপত্য চিত্রকলা কারুকলা; ছ) বাঙালির পোশাক; জ) বাঙালির খাবার; ও ঝ) বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালির বৈশিষ্ঠ্য শিরোনামের অধ্যায়সমূহে বাঙালির প্রতিদিনকার জীবনের বাঙালিত্ব সম্পর্কে অর্থাৎ নিত্যব্যবহার্য ও নিত্যদিনের বাঙালি জীবনে যা যা জড়িত সেই সব বিষয় সম্পর্কে আমাদের জ্ঞাত করেন। আলোচ্য নিবল্পেব্দ আমি প্রথম পাঁচটি অধ্যায় সম্পর্কেই আলোকপাত করব, কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে বাঙালি জাতি-জীবনের উৎস সন্ধানের জন্য এই ক'টি অধ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা বলে বাকি অধ্যায়গুলো গুরুত্বহীন তা নয়, কিন্তু একটি জাতির উৎস ও বিকাশ জানা থাকলে তার জীবনাচরণ জানাটা বেশ সহজতর হয়ে যায়।

গোলাম মুরশিদের 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' বইটিকে আমি যতটুকু বুঝেছি তাতে তিনি বোধকরি বাঙালি জাতিকে নয়, বাঙালি সংস্কৃতিকেই প্রথমেই ধরতে চেয়েছেন। ধারাবাহিক পরির্বতনের মধ্য দিয়ে একটি স্থিতিশীল সংস্কৃতি নির্মিত না হলে তা কোনো নির্দিষ্ঠ জাতির সংস্কৃতি হয় না, তা সামগ্রিকভাবে হয়তো মানব সভ্যতার একটি বৈশিষ্ঠ্য হিসেবেই থেকে যায়। লেখক আমাদের প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, এতদিন যারা বাংলা ও বাঙালিত্বের ইতিহাস লিখেছেন তা খ-চিত্র মাত্র, কারণ হিন্দু ঐতিহাসিকরা ও মুসলিম ঐতিহাসিকদের বাঙালির ইতিহাস রচনায় স্ব স্ব ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে, তা সামগ্রিক অর্থাৎ সব ধর্ম-র্বণ নির্বিশেষে বাঙালির ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। গোলাম মুরশিদ নিজেকে আপাদমস্তক একজন বিশ্বমানব মনে করেন এবং কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে তিনি নির্মোহ চেষ্ঠা করেছেন বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসকে তুলে ধরতে। ইতিহাস রচনায় এই নির্মোহ বিষয়টি বোধ করি সবচেয়ে জরুরি, নইলে তাতে সত্য গোপন করার কিংবা মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়ার সূক্ষ্ম প্রচেষ্ঠা সব সময়ই থেকে যায়। বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশের মতো একটি ভূখ-, যেখানে যুগে যুগে হাজারও র্বণ ও ধর্মের মানুষ বসতি স্থাপন করেছে এবং প্রত্যেকেই তাদের স্ব স্ব সংস্কৃতির ছাপ রেখে গেছে তাদের পরর্বতী যুগের জন্য। আধুনিক যুগে এসে হিন্দু ও মুসলিম এই দুটি প্রধান ধর্ম-ভাগে এই উপমহাদেশকে ভাগ করা গেলেও এখনো এখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা মোটেও অস্বীকার করার মতো নয়। আর ধর্মকে যদি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আমরা মেনে নিই তাহলে একথাটিও আমাদের স্বীকার করতেই হবে, উপমহাদেশের ইতিহাস বারবার যেমন ধর্ম-রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, তেমনই বারবারই এর ইতিহাসের মোড়টিও ঘুরিয়েছে এই ধর্মই।

আমরা যদি উপমহাদেশের এই পূর্বভাগ অর্থাৎ যে অঞ্চলটিকে ঐতিহাসিকরা 'বাঙ্গালা' বলে ভৌগোলিকভাবে নামায়িত করেছেন তার কথাই ধরি তাহলে আজকে আমরা এর যে আধুনিক মানচিত্রটি দেখছি তা আজকের রূপ পেতে যে সময়টা নিয়েছে তাকেই আমরা ধরে নিতে পারি বাঙালি সংস্কৃতির বয়স হিসেবে। ভৌগোলিক রূপপ্রাপ্তির সঙ্গে সংস্কৃতির যোগাযোগটি এ কারণেই হিসেবে আনছি যে, ভূমি বা যেখানে মানব বসতি সম্ভব নয় সেখানে কোনো সংস্কৃতি জন্মেরও সম্ভাবনা নেই। উপমহাদেশের পৌরাণিক মহাকাব্যসমূহ যা খ্রিস্ট জন্মের আগেই চরিত হয়েছে তাতে যদি এই বাঙ্গালা-অঞ্চলের উল্লেখ থাকে তাহলে আমরা একথা নিদির্্বধায়ই ধরে নিতে পারি যে, বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম না হলেও দু'হাজার বছর আগেও এই ভূ-খ-টি ছিল। আর ভূ-খ- থাকার আরেক অর্থ এটাও ধরে নেওয়া যায় যে, এখানে মানব-বসতিও ছিল। কিন্তু প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, সেই বসতি আসলে কাদের ছিল অথবা সেই মানব-সম্প্রদায় আসলে কারা ছিল? যারাই থাকুন না কেন, ওই মানব সম্প্রদায়ই যে আজকের বাঙালি জাতির আদি-পুরুষ তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকার কথা নয়, শুধু সময়ের কালস্রোত ধরে সেই আদি পুরুষের রক্তে বহু রক্তের (আর্য, দ্রাবিড়, অসি্ট্রক ইত্যাদি) মিশ্রণের ফলে পৃথিবীর বিস্ময়কর শংকর জাতি হিসেবে আজকে আমরা বাঙালিরা অবস্থান করছি। পণ্ডিতেরা 'বঙ্গ' শব্দের বহুবিধ ব্যাখ্যা করেছেন, তবে সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হিসেবে যেটি সবচেয়ে বেশি উল্লেখ্য সেটি হচ্ছে, 'জলমগ্ন দেশে যাহারা বসবাস করিত' (সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস)। তবে সর্বপ্রথম যিনি 'বাঙালি' বলে আখ্যায়িত করেছেন অষ্ঠাদশ শতকের সবচেয়ে বড় কবি ভারতচন্দ্র। এর আগে মধ্যযুগে বাঙালি কবিদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ করে আবদুল হাকিমই তার বাঙালি পরিচয় এবং বাংলা ভাষা নিয়ে সবচেয়ে বেশি গর্ব করেছেন। কিন্তু তিনিও এ ভাষাকে বাংলা ভাষা নামে আখ্যায়িত করেননি। বলেছেন বঙ্গবাণী, দেশী ভাষা অথবা বঙ্গদেশী বাক্য। যে মুসলমানরা বঙ্গদেশে জন্মেও বাংলা ভাষাকে আপন বলে মনে করেন না বরং এ ভাষার প্রতি হিংসা প্রকাশ করেন তাদের লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন :

...যে সব বঙ্গেত জনি্ম হিংসে বঙ্গবাণী

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি

...দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুড়ায়

নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায় (পৃষ্ঠা : ২৪-২৫)

যদিও গোলাম মুরশিদ বলেছেন, অন্নদাম্পগলের কবি ভারতচন্দ্র 'বাঙ্গালা' ও 'বাঙ্গালি' শব্দ্টয় ব্যবহার করেছেন কিন্তু তিনি কখনো 'বাঙ্গালা' দেশের ভাষাকে বাংলা ভাষা বলে কোথাও উল্লেখ করেননি। সেটা সল্ফঙ্ন্ন হয়েছে আরো পরে পতর্ুগিজ ও ইংরেজদের হাতে। ১৭৪৩ সালে লিসবন শহর থেকে যে বাংলা ব্যাকরণ ও শব্দকোষ রচনা করেন মানুয়েল দ্য আসসুল্ফঙ্সও তাতেই প্রথম বাংলাকে বেঙ্গালা বলে উল্লেখ করা হয়। ভারতচন্দ্র মারা যাওয়ার পর ইংরেজ ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড তার বাংলা ব্যকরণ গ্রনে্থ বাংলাকে বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ বলে উল্লেখ করেন। ".... হ্যালহেডের ব্যাকরণ প্রকাশের ছ'বছর পরে যখন জোনাথান ডানকানের অনূদিত কোম্পানির আইনের বই প্রকাশিত হয়, তখনও 'বাঙ্গালা' ভাষা কথাটার অনুবাদ করে ইংরেজিতে বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজই বলা হয়েছে।... ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর আগে সতি্যকার বাংলা ভাষা বিকাশ লাভ করেনি। চতুর্দশ শতাব্দীর আগে অখ বঙ্গদেশও গড়ে ওঠেনি। আর এ অঞ্চলের লোকেরা বাঙালি বলে পরিচিত হননি আঠারো শতকের আগে। সুতরাং তের-চৌদ্দ শতকের আগেকার সংস্কৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি, কিন্তু তা সতি্যকার অর্থে বাঙালি সংস্কৃতি নয়।" সূচনা অধ্যায়ের শেষ প্রানেস্ন গোলাম মুরশিদ আমাদের জানিয়ে দিলেন যে, তার মতে বাঙালি সংস্কৃতির সূচনা কখন থেকে। তিনি বাংলা ভাষার পরিপূর্ণতা প্রাপ্তি ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতি ইতিহাসের প্রধান সোপান হিসেবে। কিন্তু এখানে একটি ছোট্ট প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলা ভাষা কিংবা 'বাঙ্গালি' শব্দটি সঠিকভাবে উচ্চারিত হয়নি বলেই যে বাঙালি সংস্কৃতিকে আমরা একটি অবয়ব দিতে পারছি না এবং তাহলে এর আগে অর্থাৎ চর্যাপদ থেকে তের-চোদ্দ শতক পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়টিকে আমরা তবে কোন ভাষা কিংবা কোন সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যা দেব? এই মধ্র্যবতী সময়ের যারা তারা বাঙালি না হলে তবে তারা কি? সংস্কৃতির ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষার পূর্ণতা প্রাপ্তি পর্যন্ত সময়টুকুকে তো আমরা ছেঁটে ফেলে দিতে পারি না, তাই না? সেক্ষেত্রে আমরা গোলাম মুরশিদ কথিত ভিত্তিভূমির একটি নাম অবশ্যই আশা করতে পারি। যদিও সেই নামটি লেখক আমাদের জানাননি, ফলে আমাদের কৌতূহল এখানে আরো যেন বেড়ে যায়।

এরপরে আমরা চলে আসি 'ইন্দো-মুসলিম আমলে সংস্কৃতির রূপান্তর : মুসলিম বিজয়" অধ্যায়ে। যদিও খ্রিস্টের জন্মের একশ' বছর আগেই আমরা 'গঙ্গারিদি' সম্পর্কে জেনে গেছি এবং এও আমরা জেনেছি, বাংলায় সর্বপ্রথম নির্বাচিত রাজা হিসেবে ক্ষমতাসীন হয়েছেন বৌদ্ধ পাল রাজবংশের প্রথম গোপাল ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে রাজা প্রথম গোপালই প্রথম নির্বাচিত রাজা। (সূত্র : উইকিপিডিয়া : হিস্টরি অব বেঙ্গল)। এরপর দশম শতকে বাংলার শাসনভার হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজবংশের হাতে আসে এবং তের শতকে তুর্কি আগ্রাসনের পরে বাংলা মুসলিম শাসককুলের হস্তগত হয়। ১২০৪ সালে গৌড়ের রাজা লক্ষণ সেনের হাত থেকে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি যে বাংলার দখল নেন তা ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাত থেকে ব্রিটিশরা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর বছর পর্যন্ত বলবত থাকে। বলা বাহুল্য যে, বাংলায় এই মুসলিম শাসন চালু হওয়ার পর থেকে একটি সল্ফঙ্হৃর্ণ অপরিচিত ও ভিন্নভাষী সংস্কৃতির আগ্রাসনও শুরু হয়। কারণ বাংলায় যেসব মুসলিম বিজেতারা শাসন করেছেন তারা মূলত তুর্কি ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। বস্থুত তাদের নিজেদের মধ্যেই ধর্মের মিল ছাড়া সংস্কৃতির মিল খুব কমই ছিল। ফলে বাংলায় তের শতকের গোড়া থেকে যে নতুন একটি ধর্ম-ভিত্তিক সংস্কৃতির আগ্রাসন শুরু হয় তার জের বোধ করি আমরা এখনো টেনে চলেছি। প্রথমদিকে এই মুসলিম শক্তিটি শুধু দেশ দখলের ভাগ্যানে্বষী চিন্তাধারা নিয়ে এখানে এলেও এদেশের মাটি, এদেশের জল-হাওয়া এমনকি মানুষ ও ধনসল্ফঙ্ত্তির কারণে অনেকেই একে স্থায়ী আবাস হিসেবে বেছে নেন। বসতি স্থাপনের কিছুকাল পরেই অবশ্য তাদের ধর্মবিশ্বাসকেও এদেশের নরম মাটিতে গেঁথে দেওয়ার প্রচেষ্ঠা শুরু হয়। সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবিক আচরণবিধি মেনে হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রক্তপাতের মাধ্যমেই সল্ফঙ্ন্ন হয়। বাংলায় হিন্দু মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ গড়ার রীতিটি বহু পুরনো এবং এখনো কার্যকর একটি রীতি। সেই অর্থে বাংলায় ব্রিটিশ শাসন আসার আগেই এসেছে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদী ও ধর্মবাদী শাসন। তবু ব্রিটিশ শাসনামলে অন্তত অস্টে্পর সামনে কাউকে ধর্মত্যাগে বাধ্য করা হয়নি, সেক্ষেত্রে বাংলায় মুসলিম আমল ছিল একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে (সেটা যদি মানবিক আচরণবিধি মেনেও হয়ে থাকে তাহলেও সেটা নিন্দার্হ) স্বধর্ম ত্যাগ করে একটি দখলদারি ধর্মে দীক্ষিত করার আমল। আমার মনে হয়, উপমহাদেশের ধর্মভিত্তিক রক্তপাতের সেই যে উবোধন হয়েছিল তা এখনো বিদ্যমান এবং আগামী শতাব্দীতেও সেটা বলবৎ থাকবে। কারণ, ধর্ম-শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদাররা কেউই অন্যের ধর্মকে মেনে নিতে নারাজ আর একটি ভূ-খন্ডের আদি ও সনাতন ধর্মকে সরিয়ে সেখানে কোনো দখলদারি শক্তি তাদের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করলে নতুন ধর্মটির প্রতি পুরনো ধর্মবিশ্বাসীদের বিবেষকে অমূলক বললে সত্যকে অস্বীকার করা হবে। উপমহাদেশের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির ইতি ঘটার সম্ভাবনা নিকট ইতিহাসে তাই অসম্ভব।

আগ্রাসন কিংবা দখলদারি শক্তি কোনোকালেই দখলিকৃত ভূখন্ডের মানুষ কিংবা তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, বরং তাদের টিকে থাকা ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষে যা কিছু করার সেটাই করেছে। তবে একথা সত্য যে, তাদের সঙ্গেই এ অঞ্চলে এসেছে আরবি, ফাসর্ি কিংবা তুর্কির মতো ভাষা ও এসব ভাষাজাত সংস্কৃতি, যা পরে বাংলার সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে এবং বাংলাকে হয়তো অনেক বেশি পরিপুষ্ঠ করেছে কিন্তু তাতে বাংলা-ভূখন্ডে মুসলিম আগ্রাসনের ভয়াবহ অতীতে কোনো হেরফের হয়নি। স্বীকার্য যে, এই মুসলিম শাসকদের সহযোগিতায় তখন একটি মধ্যস্থ বা দালাল শ্রেণীও গড়ে উঠেছিল এবং এদের মাধ্যমেই ...'প্রথম দু-তিন শতাব্দীর মধ্যেই দেশীয় ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলমানদের নিয়ে আসা ভাষা-সংস্কৃতির অনেক মিশ্রণ হয়েছিল।' (পৃষ্ঠা ৩১)

তবে এই ইংরেজি শিক্ষার ফলে বাঙালি মানসে যে বিরাট পরির্বতনটি আসে সে সম্পর্কে গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, '১৮৩০-এর দশক থেকে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে কলকাতার তরুণ সমাজে উল্লেখযোগ্য পরির্বতন এসেছিল, আগেই তা উল্লেখ করেছি। তার ছাপ পড়েছিল ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক আচার-আচরণ, আশা-আকাঙ্খা এবং নিজেদের পরিচয়ের ওপর। কিন্তু নতুন যুগের তরুণরা কেবল সনাতন সমাজ থেকে সরেই গেলেন না, এক অর্থে তারা নিজেদের দেশ এবং সমাজের দিকেও তাকালেন নতুন দৃষ্টিতে। বস্থুত, ইংরেজি শিক্ষা তাদের মধ্যে একটা স্বাজাত্যবোধের জন্ম দিতে সাহায্য করেছিল। কেবল স্কুল-কলেজের শিক্ষা নয়, এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণাও বিরাট একটা ভূমিকা রেখেছিল তাতে। কারণ এ গবেষণার মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছিল একটি গৌরবোজ্জ্বল ভারতবষরাউর ধারণা। ইংরেজদের শাসন, শোষণ এবং র্বণবিবেষও সাহায্য করেছিল স্বাজাত্যবোধের উন্মেষে। সেন আমল থেকে শুরু করে বাঙালিরা প্রায় এক হাজার বছর বিদেশীদের শাসনে ছিলেন। সুলতানি আমলকে অবশ্য অনেকে বাঙালিদের শাসন বলে দাবি করেছেন। তবে এক কথায় বাঙালিরা বিদেশী শাসনকে স্থায়ীভাবে মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন যুগের শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে উনিশ শতকে প্রথমবারের মতো তাদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম এবং স্বাজাত্যবোধ দেখা দেয়।' (পৃষ্ঠা : ১৪৮)

এরপরই অবশ্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে উপমহাদেশের জনসাধারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করে। কিন্তু এরই মাঝে বাঙালির মধ্যে শহুরে ও গ্রাম্য, জমিদার ও প্রজা কিংবা আরো অনেক শ্রেণীবিভাগও সল্ফঙ্ন্ন হয়েছে। আর এসবের মাঝে ধর্মীয় বিভাজনটি যেন অন্দকার আকাশে জ্বলজ্বলে শুকতারাটির মতোই চিহিক্রত করা যেত। বিশ শতকের গোড়ায় এসে এ বিভাজনকে পুঁজি করে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী বঙ্গদেশকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। আরো মজার ব্যাপার হলো, 'বঙ্গভঙ্গ রোধ করার আন্দোলনের প্রতি সাধারণভাবে মুসলমানরা এবং নিন্মবণরাউর হিন্দুরা সমর্থন জানাননি। উল্টো বরং পূর্ববঙ্গেও গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ। বঙ্গভঙ্গ যে মুসলমানের উপকার করবে_ এ ধারণা জোরদার করার জন্য তিনি সক্রিয়ভাবে চেষ্ঠা করেন। কেউ কেউ বলেন, ইংরেজ সরকার তাকে ঘুষ দিয়েছিল। কিন্তু কারণ যা-ই হোক, যেদিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলো সেদিনই তার নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাদেশিক মুসলিম ইউনিয়ন। এর উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববঙ্গ এবং আসামের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব করা। এটিই ছিল বাংলার মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সলিমুল্লাহ এখানেই থামলেন না, পরের বছর ডিসেম্বর মাসে তিনি ঢাকায় একটি বৈঠক আহ্বান করলেন সমগ্র ভারতের বিশিষ্ঠ মুসলমান নেতাদের। সেই বৈঠকে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। বলা যেতে পারে, মুসলিম লীগের নেতৃতে্বই মুসলমানদের বি&চ্ছিম্নতাবাদ একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নেয়।' (পৃষ্ঠা : ১৬২)। অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের দুই প্রধান ধর্মগোষ্ঠীর যে বিভাজন শুরু হয়েছিল তা সাতচল্লিশে এসে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ঠ্র সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়াটি ছিল ভয়াবহ এবং নৃশংস, মানব ইতিহাসে ধর্মের কারণে এরকম রক্তপাতের নজির খুব কমই আছে। কোন পক্ষের কত মানুষ নিহত হয়েছে সে হিসেবে না গিয়ে একথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায় যে, এই রক্তপাতে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে মুসলমান নেতৃত্ব এ কথাটিই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, হিন্দু আর মুসলিম দুটি পৃথক জাতি, এই দুইয়ের পক্ষে একত্রে বসবাস সম্ভব নয়। ধর্ম দিয়ে জাতি নির্মাণের এক হাস্যকর প্রচেষ্ঠায় লিপ্ত হয় মুসলিম নেতৃত্ব। যার ফলে তারা তখন উপমহাদেশের স্বাধীনতা নয় যে কোনো প্রকারে নিজেদের একটি ধর্মরাষ্ঠ্র আদায় করে নেওয়ার জন্যই চরম রক্তপাতকে পর্যন্ত স্বাগত জানিয়েছিল। ...'দেশ বিভাগের পূর্বমুহহৃতরাউ হিন্দুরা নিজেদের সম্প্রদায়ের স্বার্থই বেশি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের অবদান ছিল অমূল্য। বলতে গেলে তাদের স্বরাজ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের চাপেই ইংরেজ সরকার স্বাধীনতার দাবি স্বীকার করে নেয়। অপর পক্ষে, মুসলিম লীগের রাজনীতি এ পথে যায়নি। মুসলমান নেতারা হিন্দুদের কাছ থেকে ক্ষমতার ভাগ নেওয়ার জন্য যতটা তাৎপর এবং সোচ্চার হয়েছিলেন, দেশের স্বাধীনতা অথবা স্বরাজ সম্পর্কে ততটা নয়। এ জন্য ইংরেজের তাঁবেদারি করতেও তারা কুণ্ঠিত হননি। অন্য ভাষায় বলা যেতে পারে, দেশের স্বাধীনতা এসেছিল প্রধানত কংগ্রেসের আন্দোলনের ফলে, মুসলিম লীগের অবদান সেখানে ছিল নিতান্তই সীমিত। মুসলিম লীগ যা করেছিল, তা হলো স্বাধীন ভারতবষরাউ মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ গঠনের আন্দোলন অর্থাৎ নিজেদের ভাগ আদায়ের আন্দোলন।' (পৃষ্ঠা : ১৭৫)। গবেষক হিসেবে গোলাম মুরশিদ এখানেই সব প্রশংসা নিয়ে নেন, কারণ এসব যুক্তি ও তত্ত্ব দিয়ে তিনি এমন এক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেন যা এখনো পর্যন্ত অনেক শিক্ষিত বিবেকই মানতে নারাজ। তাঁর সত্যকথনের এই দৃঢ়তা যে কোনো পাঠককেই মুগ্গব্দ করবে।

ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি বোধ করি বাঙালিরই হয়েছে। কারণ ধর্মভিত্তিতে এই ভাগাভাগিতে বাঙালি শুধু যে ভূ-খ-ই হারিয়েছে তাই নয়, বরং একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে দু'ভাগ করে দু'টি ভিন্ন দেশে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যেন একই মায়ের দুই সন্তানকে দু'টি সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশে নির্বাসনে দেওয়া হয়েছে। এতে এক শ্রেণীর মুসলমান বাঙালি যারপরনাই খুশি হয়েছে কারণ তারা নিজেদের বাঙালি নয়, বরং শুধু মুসলিম তাও আবার বিদেশ থেকে আগত মুসলিম বলে পরিচয় দিতেন। তারা জল আর পানি দিয়ে শুধু গোটা বাঙালি সংস্কৃতিকেই শুধু নয়, এমনকি ভাষাকে পর্যন্ত বিভক্ত করতে চেয়েছে। .'যে শিক্ষিত তরুণ মুসলমানরা বদুিব্দর মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, বরং পরিচিত ছিলেন জাতীয়তাবাদী হিসেবে, তারা মুসলমানদের জন্য কেবল স্বাধীন দেশের দাবি জানাননি, বরং পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের জন্য একটি ভিন্ন ধরনের বাংলা ভাষা তৈরি করতে হবে_ এই দাবিও জানিয়েছিলেন। এ দলে ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ।' (পৃষ্ঠা : ১৭৯)। বলাই বাহুল্য যে, এই অতি-জাতীয়তাবাদী দলটির মাথা থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামে উদ্ভট এক জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। বাঙালির শাশ্বত লোকায়ত জাতি-চিহক্রসমূহ আজ এদেরই উত্তরসূরিদের হাতে বিলীন হয়ে যেতে বসেছে। এর স্থলে সেখানে বসছে উদ্ভট মুসলমানি সংস্কৃতি, যার আগা-মাথা সম্পর্কে আমাদের কারোরই কিছু জানা নেই।

এসব অবশ্য অনেক পরের কথা। কিন্তু তার আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে আপামর বাঙালিকে একত্রিত করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি একটি স্বাধীন ভূ-খ- প্রতিষ্ঠা করেছে। সাতচল্লিশের পরে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভূমিকার সঙ্গে মোগল কিংবা ইংরেজ শাসকদের শোষণের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোনো সূচকের মাধ্যমেই প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি ও বাংলাকে শাসন ও শোষণ নয়, তাদের নিজেদের দেশের একটি অংশ বলে মনে করত। প্রথমেই তারা বাঙালির ভাষার ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, কারণ এ ভাষার ওপর ভিত্তি করেই বাঙালির জাতির অস্তিত্ব গঠিত, তাই প্রথমেই এর ওপর আঘাত হেনেছে তারা। কিন্তু বাঙালি সম্মিলিত প্রতিবাদের কাছে তাদের এ প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক উন্মাদনা তখন থিতিয়ে এসেছে বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনমানসে তখন অসাম্প্রদায়িকতা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ঠ হিসেবেই দেখা গিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনেও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। এটা নিঃসন্দেহে অতিশয়োক্তি হবে না যে, বাঙালি চরিত্রের এই অসাম্প্রদায়িকতা ও দেশপ্রেম দৃঢ়তর হয়েছিল যে মহান ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি মানসে তিনি হাজার বছরের দাসত্ব মুক্তির একটি অমিত সম্ভাবনার স্বপম্ন বুনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ...'শতাব্দীর গোড়ায় হিন্দু-মুসলমানের যে সম্পর্ক ছিল, সাত দশকের মধ্যে তা কতটা বদলে যায়, তার একটি প্রতীকী ঘটনা হলো : কলকাতায় ১৯৭১-এর দুর্গাপূজার ম-পে দেবদেবীর মূর্তির পাশে শেখ মুজিবের ছবিও টাঙানো হয়েছিল।' (পৃষ্ঠা : ২০০)। শুধু অসাম্প্রদায়িকতাই নয়, এই মহান ব্যক্তির নেতৃত্বেই বাঙালি তার নিজের চেষ্ঠায় এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে হাজার বছরের পরাধীনতার ইতিহাসকে পরাজিত করে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। হাজার বছরের বাঙালি ইতিহাসে এর চেয়ে বড় ঘটনা বোধ করি আর নেই।

শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম, গোলাম মুরশিদের 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির' প্রথম পাঁচটি অধ্যায় নিয়েই আমি কথা বলব। কিন্তু লেখাটি শেষ করে মনে হলো, পরর্বতী অধ্যায়গুলোও গবেষকের অত্যন্ত কষ্ঠ ও নিবিড়ভাবে বাঙালি পর্যবেক্ষণের ফসল। বিশেষ করে বাঙালি জাতি-চরিত্র নির্মাণে এসবের ধারাবাহিকতা আমাদের আজকের অবস্থানে আসতে সহায়তাই শুধু করেনি বরং উপমহাদেশের অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর তুলনায় বাঙালিকে করেছে স্বতন্ত্র। বিশেষ করে বাঙালির প্রণয়, পরিণয় ও পরিবার; বাঙালি নারী ও বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা গানের ইতিহাস, নাটক ও সিনেমা, বাঙালির পোশাক, বাঙালির খাবার অধ্যায়সমূহে গোলাম মুরশিদ বাঙালির সেই স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার উপপদ্যো নির্মাণ করেছেন এবং একজন সাধারণ পাঠকের কাছেও তিনি খুব সহজেই প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন, আমরা কেন ও কী জন্য বাঙালি। আমার বিশ্বাস, গোলাম মুর্শিদের সার্থকতা এই সাধারণ পাঠকের কাছেই, কারণ আমরা শুধু ইতিহাসবিমুখই নই আমাদের জানার ইচ্ছাও সীমিত। এই সীমার মধ্যেই অসীমকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন গবেষক এ বইয়ে। সবচেয়ে বড় কথাটি হচ্ছে, গোলাম মুরশিদ তাঁর 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' গ্রনে্থ এমন একটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন যা অন্য অনেক গবেষকের কাছে হয়তো তুচ্ছই মনে হতে পারে। বিষয়টি আর কিছুই নয়, বাঙালিত্ব, না কোনো ধর্ম বা ভৌগোলিক সীমানার বিভাজনের কাছে তিনি নিজেকে বিভাজ্য করেননি, তিনি অখ বাঙালি চরিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছেন এবং তাতে সল্ফঙ্হৃর্ণভাবেই সফল হয়েছেন, সে কথা আমার নিশ্চিতভাবেই মনে হয়েছে। আজকে, যখন ধর্ম ও দেশ ভাগের আক্রাযুগে আমরা খাবি খাচ্ছে আমাদের জাতি-ইতিহাস ও পরিচয় নির্মাণে তখন গোলাম মুরশিদ আমাদের যে চিরায়ত ও অখ- বাঙালি ইতিহাস শোনালেন তার জন্য তিনি কালখ্যাত হয়ে থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।